@ পরিচিতি @
লিচু
ইংরেজী নামঃ Litchi/Lychee
বৈজ্ঞানিক নামঃ Litchi chinensis
পরিবারঃ Sapindaceae
লিচু গন্ধ ও স্বাদের জন্য দেশ-বিদেশ বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম জেলায় বেশি পরিমানে লিচু উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয় এবং মোট উৎপাদন প্রায় ১৩ হাজার টন কিন্তু তা আমাদের চাহিদার মাত্র ১/৪ অংশ পূরন করে। লিচুতে ভিটামিন-বি, সি, খনিজ লবন ও ক্যাসিয়াম প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়।
@ জাত @
বোম্বাই হলো দেশের পুরানো উচ্চ ফলনশীল লিচুর জাত। এছাড়া অন্যান্য জাতের মধ্যে রাজশাহী, মাদ্রাজী, মঙ্গলবাড়ীয়া , কদমী, কালীপুরী, মুজাফফরপুরী, বেদানা এবং চায়না-৩ উল্লেখযোগ্য। সমপ্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি লিচু-১, ২ ও ৩ নামে তিনটি লিচুর জাত অবমুক্ত করেছে।
বৈশিষ্ট্য বারি লিচু-১ বারি লিচু-২ বারি লিচু-৩
ফুল আসার সময় মাঘের প্রথম প্তাহ মাঘের মাঝামাঝি মাঘের মাঝামাঝি
ফল সংগ্রহের সময় জৈষ্ঠের প্রথম সপ্তাহ আষাঢ়ের সপ্তাহ জৈষ্ঠের মাঝামাঝি
ফলের আকৃতি ডিম্বাকার গোলাকার লম্বাটে হৃদপিন্ডাকার
ফলের গড় ওজন ২০ গ্রাম ১৬ গ্রাম ১৮ গ্রাম
পাকা ফলের রং লালচে গোলাপী হলদে সবুজ ছোপসহ লাল
শাঁস শাঁস রসালো ও মিষ্টি শাঁস রসালো ও মিষ্টি শাঁস রসালো ও মিষ্টি
ফলন (গাছ প্রতি) ৫০০০ টি ৩০০০ টি ২০০০ টি
ফলের মৌসুম আগাম জাত নাবী জাত মাঝ মৌসুমী
ভক্ষণ যোগ্য অংশ ৬৫% ৬৮% ৬৭%
জাত
দেশের উত্তরাঞ্চরে জন্য উপযোগী জাত। অতি বৃষ্টি এলাকা সিলেট ও পাহাড়ী এলাকা। সমগ্র
চায়না ৩:
সমগ্র বাংলাদেশে চাষ উপযোগী একটি জাত। ফলের আকার চ্যাপ্টা গোলাকৃতি। অনেকটা প্রায় বারি-৩ লিচুর সাদৃশ্য। জুন মাসের শেস সপ্তাহে লিচু পাকে। পাকা লিচুর রং হলদে সবুজ ছোপসহ লাল। ফলের শাঁস মিষ্টি ও রসালো । ফলের বীজ আকারে ছোট। । ফলের গড় ওজন ২৫ গ্রাম। টিএসএস-১৮%। ভক্ষনযোগ্য অংশ ও বীজের অনুপাত ১৫ঃ ১।
বোম্বাই:
এ জাতটি ঈশ্বরদী, পাবনা, রাজশাহী, মেহেরপুর এলাকায় ভাল ফলন দিয়ে থাকে। ফলের আকার ডিম্বাকৃতি| অনেকটা প্রায় বারি-১ লিচুর সাদৃশ্য। মে মাসের ২য় সপ্তাহে ফল পাকে। পাকা লিচুর রং লালছে। ফলের শাঁস মিষ্টি ও রসালো । ফলের বীজ আকারে ছোট থেকে মাঝারী। ফলের গড় ওজন ১৮-২০ গ্রাম। টিএসএস-১৭-১৮%। ভক্ষনযোগ্য অংশ ও বীজের অনুপাত ৫ঃ ১
মঙ্গলবাড়ীয়াঃ আগাম লিচুর জাত। ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে চাষ উপযোগী একটি জাত। টক – মিষ্টি স্বাদযুক্ত এ জাতের ফলের বীজ আকারে বড়। এ জাতে পোকার আক্রমন প্রবনতা বেশী।
মুজাফফরপুরী: নাটোরে এ জাতটি ভাল ফলন দিয়ে থাকে। মে মাসের ২য় সপ্তাহে ফল পাকে। পাকা লিচুর রং গোলাপী। ফলের শাঁস মিষ্টি ও রসালো । ফলের বীজ আকারে বড়। ফলের গড় ওজন ২০ গ্রাম। টিএসএস-১৭-১৮%। ভক্ষনযোগ্য অংশ ও বীজের অনুপাত ৪.৭৫১।
বেদানা লিচু: দিনাজপুর জেলায় চাষ উপযোগী একটি জাত। দিনাজপুর নির্দিষ্ট এলাকার বাহিরে দিনাজপুরের অন্যান্য এলাকাতেও এ জাতটি ভাল দেয় না। সুতরাং এ জাতটি দিনাজপুরের বাহিরে অন্য কোন জেলাতে চাষ না করাই উত্তম। ফল আকারে গোলাকৃতি। পাকা লিচুর রং উজ্জল লাল। জুন মাসের ২য় সপ্তাহে ফল পাকে। ফলের গড় ওজন ২৫-২৮ গ্রাম। টিএসএস-১৮-১৯%। ফলের শাঁস মিষ্টি ও রসালো। ফলের বীজ আকােও ছোট ও কুচকানো। ভক্ষনযোগ্য অংশ ও বীজের অনুপাত ২৮ ঃ ১।
চায়না -২: এ জাতটি পার্বত্য অঞ্চলে ভাল ফলন দিয়ে থাকে। সুমিষ্ট-রসালো এ জাতের বীজের আকার তুলনামুলক ভাবে বড়।
@ জলবায়ু ও মাটি @
লিচু অবউষ্ণ মন্ডলের ফল এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় এর বৃদ্ধি ভাল হয়। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা থাকলে লিচু গাছ সব ধরণের মাটিতেই জন্মাতে পারে। তবে উর্বর বেলে দোঁ-আশ মাটি লিচরি জন্য উত্তম।
@ বংশ বিস্তার @
লিচুর অযৌন বংশবৃদ্ধির জন্য গুটি কলম একটি উত্তম পদ্ধতি হিসেবে সর্বত্রই স্বীকৃত| রোগ ও পোকা মাকড় মুক্ত সুস্থ গাছের এক বছর বয়সের ডালে গুটিকলম করা হয়। মে-জুন মাস লিচুর গুটি কলম বাঁধার উপযুক্ত সময়। শিকড় আসতে প্রায় দু’মাস সময় নেয়।
@ জমি তৈরি @
উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছামুক্ত করে নিতে হবে। বসত ভিটায় দু’একটি গাছ রোপণ করতে চাইলে জমি তৈরী না করে সরাসরি গাছ রোপণের জন্য মাদা করলেই হবে
@ রোপণ প্রণালী @
সমতল ভূমিতে বর্গাকার পদ্ধতিতে রোপণ করাই শ্রেয়। পাহাড়ী এলাকায় কন্টুর পদ্ধতিতে গাছ রোপণ করা হয়ে থাকে
@ চারা নির্বাচন @
এক বছর বয়ষ্ক সুস্থ ও সবল গুটি কলমের চারা বাছাই করতে হবে। বড় চারা রোপণ না করাই শ্রেয়।
@ চারা রোপণের সময় @
মধ্য-মে থেকে মধ্য-জুলাই এবং মধ্য-আগষ্ট থেকে মধ্য-সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত চারা রোপণ করা যেতে পারে
@ চারা রোপণের দূরত্ব @
৮ মিটার × ৮ মিটার বা ১০ মিটার × ১০ মিটার. দূরত্বে চারা রোপণ করতে হবে।
@ গর্ত তৈরি @
গর্তের আকার: ১ মিটার × ১ মিটার × ১ মিটার হওয়া প্রয়োজন।
@ সার প্রয়োগ ও চারা রোপণ @
চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে গর্ত করতে হবে এবং সার ও মাটি মিশিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হবে। চারা রোপণের সময় সাবধানে চারাটি গোড়ার মাটির বল সহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগাতে হবে। চারা রোপণের পর পানি, খুটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রোপণের ৬ মাস পরে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি গাছেই ইটের বা বাঁশের ঘের দেয়া প্রয়োজন
@ পূর্ণ বয়ষ্ক গাছে সার প্রয়োগ @
একটি পূর্ণ বয়স্ক ফলন্ত গাছের জন্য বাৎসরিক মাত্রা অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। বর্ষার আগে ও বর্ষার পর সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। নিম্নের ছকে একটি গাছের রোপণ কালীন সারের মাত্রাসহ বিভিন্ন বয়সের সারের মাত্রা দেয়া হল।
সারের নাম রোপণের সময় মাদায় প্রয়োগ রোপণের ৬ মাস পর উপরি প্রয়োগ গাছের বয়স (বছর) ও সারের মাত্রা
১-২ ৩-৪ ৫-৭ ১১-১৫ ১৬-২০ ২০ এর উর্দ্ধে
গোবর ( কেজি) ১৫-২০ – ১০ ১০ ১০ ৩০ ৪০ ৫০
ইউরিয়া (গ্রাম) – ৩০০-৩৫০ ৩০০-৩৫০ ৪০০ ৫০০ ১২০০ ১৫০০ ২০০০
টিএসপি (গ্রাম) ৬০০-৭০০ – – ৫০০ ৭৫০ ২১০০ ২৭০০ ৩৫০০
এমপি (গ্রাম) ৩৫০-৪৫০ – – ২০০ ৪০০ ১২০০ ১৬০০ ২০০০
জিপসাম (গ্রাম) ২০০-৩০০ – – ১০০ ১০০ ১৫০ ২০০ ২৫০
জিংক সালফেট (গ্রাম) ৪০-৬০ – – ১০ ১০ ৩০ ৪০ ৫০
@ অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা @
পানি সেচ
চারা গাছের বৃদ্ধির জন্য মাঝে মাঝে সেচ দিতে হবে। যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হয় তবে ফলন্ত গাছের বেলায় পূর্ণ ফুল ফোটা সময়ে একবার এবং ফল মটর দানার আকৃতি ধারণ পর্যায়ে আর একবার সেচ দিলে ভাল ফলন হয় । বেসিন পদ্ধতি সেচ দিতে হবে। তবে গাছে মুকুল আসার তিন মাস আগ থেকে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে
রোগ বালাই ও পোকামাকড় দমন
লিচুর মাইট ও লিচু ফল ছিদ্রকারী পোকা লিচুর ক্ষতি করে থাকে।
লিচুর মাইট
আক্রান্ত লিচু গাছের পাতাগুলো মাইটের আক্রমণে লাল ভেলভেট এর মত দেখায় এবং পাতাগুলো কুঁকড়িয়ে আলাদা আকৃতি ও বর্ণের হয়। লিচুর মাইট দমনে রাখতে হলে ফল সংগ্রহের পর আক্রান্ত সকল পত্রগুচ্ছ কেটে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সাধারণত দুই থেকে তিন বছর জৈষ্ঠ্য-অষাঢ় এবং শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে আক্রান্ত ডালপালা বা ডগা ছাঁটাই এবং ধ্বংশ করতে হবে। এ ছাড়া নিওরন/ ওমাইট ২ মিলি প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছের নতুন পাতায় ১৫ দিন পর পর ভালভাবে সেপ্র করে মাইট দমনে রাখা যায়
লিচু ফল ছিদ্রকারী পোকা
ফল পাকার সময় এ পোকা ফলের বোটার কাছে ছিদ্র করে ফলের ভিতর ঢুকে এবং বীজকে আক্রমণ করে। পরে ছিদ্রের মুখে বাদামী রংয়ের করাতের গুড়ার মত এক প্রকার মিহি গুড়া উৎপন্ন হয়। এতে ফল নষ্ট হয় এবং বাজার মূল্য কমে যায়। লিচু ফলের বোটার দিকে ফলের খোসার নিচেই এ পোকার কীড়া দেখা যায়। ফল পাকার ১.৫ মাস পূর্বে ফল ব্যাগিং করে বা প্রতি লিটার পানিতে ১ মি.লি সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড/ সিমবুস/ ফেনম) ১০ ইসি বা ডেসিস ২.৫ ইসি মিশিয়ে ফলের গুটি ধরার পর একবার এবং তার ১৫ দিন পর একবার প্রয়োগ করে পোকা দমন করা যায়
বাঁদুর তাড়ানো
ফল পাকার সময় বাঁদুর পাকা ফলের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। এ জন্য জাল দিয়ে পাকা ফল সমেত গাছ ঢেকে দেয়া হয়। সারা রাত্রি ঢোল বা টিন পিটিয়ে বাঁদুর তাড়ানো হয়। কোথাও কোথাও দুই সারি গাছের মাঝে বড় বড় খোপযুক্ত নাইলনের জাল টানিয়ে দিয়ে বাঁদুর তাড়ানো হয়।
@ ফল আহরণ ও ফলন @
ফল ধারণ থেকে শুরু করে ৫৫-৬০ দিন পরেই ফল আহরণের উপযুক্ত হয়। ফলে রং ধরলে বুঝতে হবে আহরণের সময় হয়েছে । পাতাসহ গোছায় গোছায় লিচু ফল আহরণ করতে হয়। এতে লিচু বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায়। পূর্ণ বয়স্ক লিচুগাছ থেকে বছরে ২০০০-৪০০০ ফল আহরণ করা যেতে পারে।
@ তথ্য সূত্র @
১। Lychee production in the Asia – Pacific Region, FAO Regional Office, Thailand.
২। বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় গাছ-গাছড়া. ড. তপন কুমার দে, জানুয়ারী’২০০৬।
৩। ফলের আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, জয়দেবপুর, গাজীপুর, ২০০৫।
৪। উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তি, বারি, ২০০৫-০৬।
৫। সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন ম্যানুয়াল, ডিএই, ঢাকা।
৬। লিফলেট, এনসিডিপি, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা।
৭। মোঃ এনামুল হক, ফল ু সব্জীর চাষ ও পুষ্টি পরিচিতি, ডিএই, , খামারবাড়ি, ঢাকা
No comments:
Post a Comment